ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

প্যাথলজি রিপোর্টে অনির্ভরযোগ্যতা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের নির্ভরশীলতা কেন

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার  :
প্যাথলজির ভুল রিপোর্টের কারণে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় জান যায় অবস্থা হচ্ছে রোগীর। এমন ঘটনা অহরহ ঘটলেও চিকিৎসকদের ‘যন্ত্র’ নির্ভরতা মোটেও কমছে না। এতে করে একদিকে রোগী ও তাদের অভিভাবকেরা আর্থিক ও শারীরিক অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে চিকিৎসক সমাজের উপর তৈরী হচ্ছে আস্থাহীনতা। এরই জের ধরে সামান্য অসুস্থতার কারণেও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে বিত্তশালীরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান- উচ্চ মূল্যের পরীক্ষা ফি নেওয়ার পরও কক্সবাজারের প্যাথলজি সেন্টারগুলো থেকে ইসিজি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষার প্রায়ই ভুল রিপোর্ট পাচ্ছেন রোগীরা। পাওয়া যাচ্ছে অন্যান্য পরীক্ষাতেও। আর এসব রিপোর্টের প্রেক্ষিতে চিকিৎসকরাও ভুল চিকিৎসা দিচ্ছেন রোগীদের। আর ভুল চিকিৎসায় রোগীরা সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরো বড় জটিলতার সম্মুখিন হচ্ছে। শরীরে ডেকে আনছে ‘সর্বনাশ’। অনেক সময় ভুল চিকিৎসায় জীবনই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে রোগীর। কেউ কেউ চিরতরে শারীরিক প্রতিবন্দীা হয়ে পড়ছে। এরপরও ‘অনির্ভরযোগ্য’ প্যাথলজি রিপোর্টের প্রতি চিকিৎসকদের এত নির্ভরশীলতা কেন- গত কয়েকদিন ধরে এমনই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন মহলে।
জানা যায়, চলতি মাসের ১৩ তারিখ প্যাথলজির ভুল রিপোর্টের কারণে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছিল তিন বছরের শিশু পরাগ বড়–য়াকে। রোগীর অবস্থার অবনতির পর দ্বিতীয় দফা পরীক্ষায় ‘অ্যাপেনডিক্স ফেটে গেছে’ ধরা পড়লে দ্রুত অপারেশনে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে শিশুটি। একইভাবে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছিল খিন মে রাখাইন নামের আরেক রোগীকেও। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে শিশু দুটি বেঁচে যায়। ভূক্তভোগী পরাগ বড়–য়ার বাবা মাছরাঙা টেলিভিশনের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক সুনীল বড়–য়া জানান, ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও তার শিশুটির বমি ও পেট ব্যথা না সারায় তিনি কক্সবাজারের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এম এন আলমের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় রোগীর ‘এপেনডিসাইটিস’ হয়েছে বলে ধারণা করেন। এরপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্যান্য কিছু টেস্টের সাথে জরুরী আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করাতে বলেন। বিকালে শেভরণে ডা. এম এস আলম প্রিন্স আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়ে রিপোর্ট দেন ‘কৃমি সমস্যা’ বলে। ফলে শিশু বিশেষজ্ঞ ‘কৃমি সমস্যা’ সারানোর ওষুধ দেন। কিন্তু ওষুধে শিশুটির অবস্থার আরো অবনতি হলে শিশু বিশেষজ্ঞ রোগীকে পুনরায় সিআইসিতে ডা. ওসমানুর রশিদের কাছে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষার জন্য পাঠান। এরপর নতুন রিপোর্টে ধরা পড়ে তার (শিশু বিশেষজ্ঞের) আগের ধারণাই সঠিক অর্থাৎ ‘এ্যাপেনডিসাইটিস’। এসময় ওই চিকিৎসক একঘন্টার মধ্যে জরুরী অপারেশনেরও পরামর্শ দেন। এরপর শহরের জেনারেল হসপিটালে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক সার্জারী বিশেষজ্ঞ ডা. সাখাওয়াত হোসেন ও লাইফ সাপোর্ট এনেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান পাল এর তত্ত্বাবধানে জরুরী অপারেশন করে শিশুটির পেট থেকে ‘এপেনডিক্স’ অপসারণ করা হয়। এভাবে জরুরী অপারেশনের মাধ্যমে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে শিশুটি।
এরপর শিশুটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠলে হাফ ছেড়ে বাঁচেন রোগীর অভিভাবকেরা। এই ধরনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। ভুল চিকিৎসায় কারো মুত্রথলি, কারো কিডনি বা লিভার নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকেই হয়ে পড়েছে পঙ্গু। তবে পরবর্তীতে ভুল রিপোর্টের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে প্রশ্ন করলে উত্তর দেন- ‘আমি কেন ভুল রিপোর্ট দিতে যাব? মেশিন যেভাবে দেখিয়েছে আমি সেভাবেই রিপোর্ট দিয়েছি।’
আবার প্যাথলজি থেকে ভুল রিপোর্ট আসাকেও ‘গ্রহণযোগ্য’ মনে করছেন চিকিৎসকরা। এভাবে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না রোগীরা। যদিও ভুল চিকিৎসার কারণে চরম টেনশন ও আর্থিক হয়রানির শিকার হতে হয় রোগী ও তাদের অভিভাবকদের।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক সার্জারী বিশেষজ্ঞ ডা. সাখাওয়াত হোসেন বলেন- ‘আলসনোগ্রাম’ ও ‘ইসিজি’তে ভুল রিপোর্ট আসা স্বাভাবিক। কারণ এই রিপোর্টগুলো শরীরের তাৎক্ষণিক আচরণের উপর নির্ভরশীল, যা মুহুর্তের পর পরিবর্তন হয়েও যেতে পারে।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের লাইফ সাপোর্ট এনেসথেসিয়া কনসালটেন্ট ডা. বিধান পালও মনে করেন ‘আলট্রাসনোগ্রাম’-এ ভুল রিপোর্ট আসা ‘এক্সেপটেবল’ বা গ্রহণযোগ্য। চিকিৎসাবিদ্যায় বিষয়টি এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে কোন প্যাথলজি রিপোর্টের উপর নিশ্চয়তা দেয়া কোন চিকিৎসকের উচিৎ নয় বলে মনে করেন তিনি।
ঘটনার ব্যাপারে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা পুচনুর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল নম্বরে বার বার ফোন করা সত্ত্বেও কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি (ক্যাব) জেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী মনে করেন, রোগীদের প্রতি অবহেলার কারণে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থাহীনতা তৈরী হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সমস্যা উত্তরণে চিকিৎসক সমাজকেই কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।

পাঠকের মতামত: